দারুল উলুম জাহাঙ্গীর আলম কওমী মাদ্রাসার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কেবল শিক্ষাদান বা সনদ বিতরণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা আরও গভীর, বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী:
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন: আমাদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হলো—আল্লাহ তা'আলা যেন এই প্রতিষ্ঠানকে দ্বীনের এক শক্তিশালী মারকাজ (কেন্দ্র) হিসেবে কবুল করেন। এখান থেকে যেন এমন একদল মানুষ তৈরি হয়, যারা কেবল দুনিয়ার জ্ঞান নয়, বরং আখেরাতের পাথেয় নিয়ে জীবন পরিচালনা করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হবে।
২. ব্যাপক সুনাম ও পরিচিতি: আমরা চাই আমাদের এই দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও সুখ্যাতি যেন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যেন এই প্রতিষ্ঠানকে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
৩. শিক্ষার মানোন্নয়নে নিরন্তর প্রচেষ্টা: আমরা শিক্ষার মানকে সর্বদা উন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর। কেবল গতানুগতিক শিক্ষাদান নয়, বরং সময়ের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যক্রমকে আরও আধুনিক ও কার্যকর করার দিকে আমরা সবসময় প্রস্তুত থাকি। চারিত্রিক ও নৈতিক উৎকর্ষতার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরকে যেন সঠিক দীনি জ্ঞান ও কর্মমুখী দক্ষতা দিয়ে সমাজ গঠনে সক্ষম করে তোলা যায়, তার দিকে আমাদের সর্বোচ্চ নজর থাকে।
দারুল উলুম জাহাঙ্গীর আলম কওমী মাদ্রাসার সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি হলো এর শিক্ষক মণ্ডলী, যারা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিজেদেরকে একদম ভিন্ন ও পেশাদার স্তরে প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি কেবল সাধারণ শিক্ষিত শিক্ষকদের উপর নির্ভর করে না, বরং শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে উচ্চমান বজায় রাখতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়।
নূরানী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক: এই প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক নূরানী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। কওমী ধারার শিক্ষায় নূরানী পদ্ধতি একটি অত্যন্ত কার্যকর ভিত্তি, যা শিশুদেরকে খুব সহজে ও শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত এবং প্রাথমিক দ্বীনি জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে। সকল শিক্ষকের এই বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকার কারণে শিক্ষাদান পদ্ধতি সুসংগঠিত এবং শিশুদের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়।
সুশিক্ষায় শিক্ষিত ও পেশাদার: এখানে কর্মরত সকল শিক্ষকই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুশিক্ষায় শিক্ষিত এবং অত্যন্ত পেশাদার। তারা শুধু ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী নন, বরং শিক্ষাবিজ্ঞানের আধুনিক ধারণা এবং শিশুদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কেও সচেতন। তাদের শিক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে আন্তরিকতা, ধৈর্য এবং প্রতিটি শিক্ষার্থীর প্রতি ব্যক্তিগত মনোযোগ।
আদর্শিক ও চরিত্রবান: জ্ঞান ও দক্ষতার পাশাপাশি, শিক্ষকরা আদর্শিক চরিত্র এবং ইসলামী মূল্যবোধের জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে কাজ করেন। তারা কেবল পাঠ্যবই পড়ান না, বরং তাদের জীবনযাত্রা ও আচরণ দ্বারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে উন্নত নৈতিকতার বীজ বপন করেন। এই প্রশিক্ষিত, সুশিক্ষিত ও নিবেদিত শিক্ষক মণ্ডলীর কারণেই দারুল উলুম জাহাঙ্গীর আলম কওমী মাদ্রাসা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাস্থ্যকর আবাসন ও মনোরম পরিবেশ (নতুন সংযোজন)
দারুল উলুম জাহাঙ্গীর আলম কওমী মাদ্রাসা কেবল একটি শিক্ষালয় নয়, বরং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি দ্বিতীয় বাড়ি। এই প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যকর আবাসন এবং সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ নিশ্চিত করার উপর জোর দেয়।
আধুনিক ও স্বাস্থ্যকর হোস্টেল: মাদ্রাসার আবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এবং স্বাস্থ্যসম্মত হোস্টেল ব্যবস্থা। এখানে পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধির উপর কঠোর নজরদারি রাখা হয়।
নিয়মিত স্বাস্থ্য তদারকি: সিসি ক্যামেরা এবং শিক্ষকদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।
মনোরম শিক্ষাঙ্গন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম এবং পড়ালেখার উপযোগী। এখানে অযথা কোলাহলমুক্ত একটি শান্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ সহকারে জ্ঞানার্জন করতে পারে। প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সুশৃঙ্খল বিন্যাস শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
শিক্ষার্থীরা যেন শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় আবদ্ধ না থাকে, সেজন্য দারুল উলুম জাহাঙ্গীর আলম কওমী মাদ্রাসা বিভিন্ন সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমে উৎসাহ দেয়। এটি শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে এবং নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জনে সহায়ক।
বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভা: শিক্ষার্থীদের আরবী ও বাংলা ভাষায় বাগ্মিতা ও যুক্তি উপস্থাপনের দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা: কুরআনের হাফেজদের জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, যেখানে এই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা প্রায়শই সাফল্য অর্জন করে।
সামাজিক ও জনসেবামূলক কাজ: মাদ্রাসার পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক ও জনসেবামূলক কার্যক্রমে অংশ নেয়, যেমন – পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বন্যার্তদের সহায়তা এবং ধর্মীয় বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি। এই কার্যক্রমগুলো শিক্ষার্থীদেরকে সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: পড়ালেখার পাশাপাশি শরীরচর্চা ও বিনোদনের জন্য নিয়মিত খেলাধুলা ও বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করে।
দারুল উলুম জাহাঙ্গীর আলম কওমী মাদ্রাসা কেবল প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকের একক উদ্যোগে দাঁড়িয়ে নেই, বরং এটি স্থানীয় কমিউনিটি, প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের অকৃত্রিম আস্থা ও পৃষ্ঠপোষকতার ফল।
জনগণের সম্পৃক্ততা: এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি উন্নতি এবং প্রসারে এলাকাবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং আর্থিক সহযোগিতা রয়েছে। এই মাদ্রাসাকে তারা তাদের নিজেদের সম্পদ এবং এলাকার ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতীক মনে করে।
স্বচ্ছ আর্থিক ব্যবস্থাপনা: সিসি ক্যামেরা এবং ডিজিটাল তদারকির পাশাপাশি, মাদ্রাসার আর্থিক লেনদেন এবং ব্যবস্থাপনায় উচ্চমাত্রার স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়। এই স্বচ্ছতা জনগণের আস্থা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
প্রাক্তন ছাত্রদের ভূমিকা: মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হয়েও তাদের শিক্ষালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রেখেছে। তারা বর্তমান শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে এবং প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা প্রদান করে থাকে।
শিক্ষাই আলো। সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সুশিক্ষিত জাতি আগামীর ভবিষ্যৎ। এ উপদেশবাণীগুলোর চেয়েও শিক্ষার ইতিহাস অনেক পুরনো। কারণ শিক্ষার ভালো ফল পাওয়ার পরই সম্ভবত এই উপদেশবাক্যগুলোর জন্ম। মানবসভ্যতার বয়স যতদিন, শিক্ষার বয়সও ততদিন।
কারণ মানুষকে সৃষ্টিকর্তা একজন জ্ঞানী ও খলিফা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। উম্মতে মুহাম্মদির শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা হয় সৃষ্টিকর্তার বাণী- পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন (সূরা: আলাক, আয়াত-১)।
মসজিদে নববীতে অবস্থিত ‘সুফফা’ হলো ইসলামের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয়। রাসূল সা: ছিলেন প্রথম শিক্ষক এবং সাহাবিগণ প্রথম ছাত্র। এখান থেকে ইসলামী শিক্ষার ইতিহাস শুরু হয়।
খোলাফায়ে রাশেদিন, উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং শিক্ষাব্যবস্থা একটি পরিপূর্ণতা লাভ করে। মুসলিম শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসকগণ শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক অবদান রাখেন। তারা ইসলামী শিক্ষার একটি বুনিয়াদি কাঠামো দাঁড় করিয়ে ছিলেন।
শুধু রাজধানী দিল্লিতেই এক হাজার মাদরাসা ছিল। প্রফেসর ম্যাক্স মুলারের মতে ব্রিটিশ শাসনের আগে শুধু বাংলাতেই ৮০ হাজার মাদরাসা ছিল। ক্যাপ্টেন হেমিলটনের মতে, সিন্ধুর প্রসিদ্ধ ঠাট্টানগরীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং শিল্পকলার ৪০০ প্রতিষ্ঠান ছিল।
১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পরাজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম শাসনের ইতি ঘটে। সূচনা হয় ইংরেজ শাসন। ইংরেজরা তাদের শাসনব্যবস্থা দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার জন্য উরারফব ধহফ ৎঁষব নীতি প্রয়োগ করে। মূল লক্ষ্য ছিল দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করা। ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকেলের সুপারিশকৃত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে দুই বিপরীতমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।
তাদের এ নীতি সফলতার সাথে বাস্তবায়ন হয়েছে। ব্রিটিশ আমাদের এ দেশ থেকে চলে গেছে সেই ১৯৪৭ সালে ঠিকই কিন্তু তাদের সৃষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা আজো অক্ষুণ্য আছে। এ দীর্ঘ সময়ে পাঠ্যসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন এলেও শিক্ষানীতির মূল কাঠামো আজো অপরিবর্তিত। কিন্তু আদর্শ জাতি গঠনে মাদরাসা শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাপক।
আল্লামা ইকবাল বলেন, খুদি বা রূহের উন্নয়ন ঘটানোর প্রক্রিয়ার নামই শিক্ষা। শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শের কাজ হলো পরিপূর্ণ মানবসত্তার লালন করে এমনভাবে গড়ে তোলা। যার এমন একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি যে, মানুষ তার দেহ, বুদ্ধিবৃত্তি এবং আত্মা তার বস্তুগত ও আত্মিক জীবন এবং পার্থিব জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপের কোনোটিই পরিত্যাগ করে না। আর কোনো একটির প্রতি অবহেলা বা মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকেও পড়ে না।
মিল্টনের মতে, শিক্ষা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বিকশিত মুক্ত সচেতন মানবসত্তাকে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে উন্নত যোগসূত্র রচনা করার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া যেমনটি প্রকাশিত হয়েছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত এবং ইচ্ছাশক্তিসম্বন্ধীয় পরিবেশে। শিক্ষার উদ্দেশ্যই নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা।
সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে মানবজাতিকে সঠিক জীবন যাপনের জন্য যেসব নবী-রাসূলকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল তাদের কাজ সম্পর্কে সৃষ্টিকর্তা বলেন, তারা আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন বা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের মানদণ্ড সম্পর্কে মানুষকে পড়ে শুনান। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেন আর শিক্ষা দেন জীবন যাপনের কৌশল। অথচ এর আগে তারা ছিল সুস্পষ্ট গুমরাহিতে নিমজ্জিত। (সূরা: জুমা, আয়াত ২)।
ইসলামী যুগের শুরুতে, মধ্যযুগে এবং অতি সাম্প্রতিক কালেও ঔপনিবেশিক যুগের আগ পর্যন্ত মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ছিল কুরআন, হাদিস, সিরাত ও ফিকাহর ওপর। এর সাথে সাথে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, যাবতীয় সায়েন্স এসবের গুরুত্ব ছিল। ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থ বা মনীষীর বাণীতে পাওয়া যাবে না।
কুরআনের প্রথম শব্দই ছিল শিক্ষাসংক্রান্ত। যেমন সৃষ্টিকর্তা বলেন, পড়ুন আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ঝুলে থাকা বস্তু থেকে। পড়ুন আর আপনার রব মহামহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না (সূরা: আলাক, আয়াত ১-৫)।
রাসূল সা: হেরা গুহায় অহি প্রাপ্ত হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় ফিরে এসে তাঁর সহধর্মিণী খাদিজা রা:-এর কাছে সব ঘটনা খুলে বলেন। রাসূল সা: আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষা লাভ করে ঘোষণা করেন, আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি (ইবনে মাজাহ)। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ (ইবনে মাজাহ )। নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে রাসূল সা: ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে যুদ্ধবন্দী ৭০ জনের মুক্তিপণ হিসেবে ঘোষণা করেন, যারা লেখাপড়া জানেন তারা ১০ জন নিরক্ষর ব্যক্তিকে অক্ষরজ্ঞান দান করে মুক্তি পাবেন।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি সেটা হলো দারুল আরকাম। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আরকাম রা: ছিলেন এই ঘরের মালিক। মুসলমান হওয়ার পর তিনি ইসলামের জন্য এই ঘরটি ওয়াকফ করে দেন।
মদিনার মুসলমানদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল সা: হজরত মুসাব ইবনে উমায়ের (রা:)কে শিক্ষক হিসেবে মদিনায় প্রেরণ করেন। তিনি আবু উসামা ইবনে জুরারার বাড়িতে অবস্থান করে কুরআন শিক্ষা দিতেন। সেটিই মদিনার প্রথম শিক্ষালয় হিসেবে পরিগণিত হয়।
হিজরতের সময় রাসূল সা: এর বাহন উটনী আবু আইয়ুব আনসারী রা: এর বাড়িতে গিয়ে থেমে যায়। রাসূল সা: সেই বাড়িতে অবস্থান করে প্রায় আট মাস শিক্ষাক্রম চালিয়ে যান।
মসজিদে নববীর উত্তর পাশে খেজুর পাতায় ছাউনি দিয়ে একটি আবাসস্থল নির্মাণ করা হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসে সুফফাহ নামে পরিচিত। সেখানকার অধিবাসীরা আহলে সুফফাহ নামে পরিচিত।
রাসূল সা:-এর শিক্ষাব্যবস্থা ছিল একীভূত শিক্ষাব্যবস্থা। সেখানে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবাই জ্ঞান লাভের সমান সুযোগ পেত। রাসূল সা: কন্যাসন্তানদের শিক্ষা দানের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদান করেছেন।
রাসূল সা: ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তানকে লালন-পালন করবে, তাদেরকে শিষ্টাচার শিক্ষা দেবে, তাদের বিয়ে দেবে এবং তাদের সাথে ভালো আচরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে (আবু দাউদ)। রাসূল সা: এর সহধর্মিণী আয়শা (রা:) শিক্ষা-দীক্ষায় বিরাট অবদান রাখেন। তিনি হাদিস, ফিকাহ শাস্ত্রসহ সব বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তাঁর থেকে ২ হাজার ২১০টি হাদিস বর্ণিত হয়।
ইলমই হলো আল্লাহর কাছে মর্যাদা বৃদ্ধির প্রথম উপায়। সৃষ্টিকর্তা বলেন, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম বা জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে তাদের মর্যাদা আল্লাহ বাড়িয়ে দেবেন (সূরা: মুজাদালা, আয়াত- ১১)।
ইলম শিক্ষা করার জন্য পথচলা, হাঁটা, কষ্ট করা ইত্যাদিও ইবাদত। এগুলোর মর্যাদা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত বেশি। (বুখারি, মুসলিম)। শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে কারির মর্যাদা সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেন- কুরআনের কারিকে বলা হবে পড়ুন এবং সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকুন এবং সুমধুর কণ্ঠে পড়তে থাকুন যেভাবে তারতিলের সাথে দুনিয়াতে পড়েছেন। নিশ্চয় আপনার গন্তব্য হবে সেখানে যেখানে পড়া শেষ হবে (তিরমিজি, আবু দাউদ )।
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণিত- রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন- আলিম ও আবেদের পুনরুত্থান হবে। অতঃপর আবেদকে বলা হবে তুমি জান্নাতে যাও। আর আলেমকে বলা হবে তুমি দাঁড়াও, যাতে তুমি যে শিক্ষা দিয়েছ সে কারণে সুপারিশ করতে পারো (বায়হাকী)।
মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় অবদান হলো সৎ ও আদর্শ ব্যক্তি গঠন। পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের পর ইসলাম ও মুসলমানদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণের নিমিত্তে ১৮৬৬ সালের ৩০ মে হযরত মাওলান ক্বাসেম নানুতবী (রহ:) প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা। স্যার সৈয়দ আহমদ খান স্থাপন করেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭৮১ সালে মুসলমানদের চাপের মুখে আরবি শিক্ষার ব্যবস্থা স্বরূপ কলকাতায় (পশ্চিমবঙ্গে) বর্তমান ঢাকা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।
মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা তাহজিব-তমদ্দুন, কৃষ্টি-সভ্যতা, দীন-ঈমান, ইজ্জত-আবরু ইত্যাদি সংরক্ষণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।
মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের অনৈতিক কাজে যেমন চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ব্যভিচার, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক ইত্যাদির সাথে সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করার মতো নজির তেমন পাওয়া যায় না।
মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরি করার পাশাপাশি মসজিদে জুমার খুতবা, ওয়াজ মাহফিল, সভা-সেমিনার ও ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সৎভাবে জীবনযাপন করার উপদেশ দেন।
তাদের উপদেশ শুনে সাধারণ মানুষ সৎভাবে জীবনযাপন করার চেষ্টা করেন। তা ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি মাদরাসাগুলো অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান ও অসহায় এতিম শিশুদের বিত্তবানদের সহযোগিতায় নিরক্ষরতা দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। অতএব সৎ ও আদর্শ জাতি গঠনে মাদরাসা শিক্ষার ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
রাসূল (সা:) শিক্ষার আলো দিয়ে একটি বর্বর ও অশিক্ষিত জাতিকে সুশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খলিত ও সর্বোত্তম জাতিতে রূপান্তর করতে সক্ষম হন।
আমাদেরও উচিত মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন ঘটিয়ে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা যাতে আমাদের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তেমন কোনো পার্থক্য না থাকে। আবার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটিয়ে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে আসা উচিত যাতে মাদরাসা শিক্ষার ইসলামী ধ্যান-ধারণা ও পরিবেশের সাথে তেমন কোনো পার্থক্য না থাকে। নৈতিক, আদর্শিক ও চারিত্র্যিক দৃঢ়তাসম্পন্ন জনশক্তি উৎপাদনের জন্য ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার কোনো বিকল্প নেই। এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থায় অগ্রধিকার পাওয়া উচিত।
সর্বোপরি ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই সন্তানকে পরিপূর্ণ ইসলামী শিক্ষাদানের যথাযথ ব্যবস্থা করা নৈতিক দায়িত্ব। এটা নবুয়তি কাজের অন্তর্ভুক্ত।
পিতা-মাতা সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে পরকালে তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সৃষ্টিকর্তা বলেন, হে আমাদের পালনকর্তা, যেসব জিন ও মানুষ আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, তাদেরকে দেখিয়ে দাও, আমরা তাদেরকে পদদলিত করব, যাতে তারা যথেষ্ট অপমানিত হয় (সূরা: হা-মীম-সিজদা, আয়াত-২৯)। অতএব আদর্শ জাতি গঠনে মাদরাসা শিক্ষা এক অপরিহার্য মাধ্যম।